খালেদার আপসহীন ৩৬ বছরে পাঁচবার সংসদে

জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে দুইবারের বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নিহত হওয়ার পর একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসেন তিনি। এর পর থেকে ৩৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি আপসহীন ভূমিকা নিয়ে বিএনপির হাল ধরে আছেন।

রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখার পাঁচ দিনের মাথায় ১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত, আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন।

বিগত কিছুকাল যাবৎ আমি বিএনপির কার্যক্রম গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। দলের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হতে পারে এমনটা মনে করে আমাকে দলের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তাই দলের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপিতে যোগ দিয়েছি ও দলের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছি।’

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ গায়ের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলনে নামেন খালেদা জিয়া। রাজপথের নেত্রী হিসেবে ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দীর্ঘ ৯ বছর তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। স্বৈরশাসনবিরোধী আপসহীন ভূমিকার জন্য সে সময় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাকে ‘মোস্ট আনকম্প্রমাইজিং লিডার অব দি ইস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। দেশের জনগণ তাঁকে অভিহিত করে ‘দেশনেত্রী’ অভিধায়।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নিহত হওয়ার পর একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসেন তিনি। এর পর থেকে ৩৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি আপসহীন ভূমিকা নিয়ে বিএনপির হাল ধরে আছেন

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রাজপথে নেমে আসে জনতা। আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। দেশে ফিরে আসে গণতন্ত্র। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে বিএনপি। খালেদা জিয়া দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

এ সময় গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীর পানি প্রাপ্তিতে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে খালেদা জিয়া জাতিসংঘের অধিবেশনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাবি উত্থাপন করেন। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। সেটিতে বিরোধী সব দল অংশ না নেওয়ায় একই বছর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় এবং সেখানে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে গণতন্ত্র ও দেশের উন্নয়নে ছায়া সরকার হয়ে কাজ করেন। ২০০১ সালে জনগণের ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান খালেদা জিয়া।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিপর্যস্ত হয় দেশের গণতন্ত্র। জারি হয় জরুরি অবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন সরকার। খালেদা জিয়াকে দেশত্যাগে বাধ্য করতে চাইলেও তিনি সাফ বলে দেন, ‘মরতে হলে এ দেশেই মরব।’ একপর্যায়ে তাঁকে কারান্তরীণ করা হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমান ও কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমানও কারাবন্দি হন।

সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসেন খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েই দেশে একদলীয় শাসন কায়েমের লক্ষ্যে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছেন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতার পদ হারান।

এরপর অবরোধ ও গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তিন মাস অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেও ব্যর্থ হন তিনি। এর মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর।

বিএনপি চেয়ারপারসন হিসেবে রাজনীতিতে পা রাখার পর এরই মধ্যে ৩৬ বছরের বেশি সময় পার করেছেন খালেদা জিয়া। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে একটি দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ রয়েছেন তিনি। দলটির নেতাদের বিশ্বাস, মিথ্যা মামলায় তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। আপস করলে তিনি অনেক আগেই মুক্ত হতেন। কিন্তু আপসহীন নেত্রী গণতন্ত্রের স্বার্থে আপস করবেন না।–কালেরকন্ঠ